রাঙ্গামাটির দর্শনীয় স্থান: যেগুলো কখনওই মিস করবেন না রাঙ্গামাটি, এক অপার সম্ভাবনার জেলা, যেখানে প্রকৃতি সারা বছর অপরূপ সাজে সেজে থাকে। এই পাহাড়ি জনপদ একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে, যা সারা বছর পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে এমন কিছু স্থানের বিবরণ, যা রাঙ্গামাটিতে ঘুরতে এলে কখনও মিস করা উচিত নয়।
কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমণ ৭২৫ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল আকৃতির কাপ্তাই হ্রদের নীল জলে নৌ-ভ্রমণ পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যেই পর্যটকই রাঙ্গামাটিতে আসেন, হ্রদে ভ্রমণ না করে ফিরে যান না। এই নীল জলে বোটে চড়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়।
সুবলং ঝরনা হ্রদ ভ্রমণে গেলে অধিকাংশ পর্যটকের গন্তব্য থাকে সুবলং ঝরনা। শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার বোট জার্নি করে পৌঁছানো যায় এই ঝরনায়। পথটি অসম্ভব সুন্দর, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় সবুজে আচ্ছাদিত বিশাল পাহাড় ও নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা মুগ্ধ করবে যে কাউকে। তবে ঝরনার আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে বর্ষা মৌসুমে আসতে হবে, শীতে পানি থাকে না।
ঝুলন্ত সেতু বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্পের আইকন হিসাবে পরিচিত। এই সেতুটি দুইটি পিলারের ওপর ক্যাবলের সাহায্যে নির্মিত, যা দুটি পাহাড়কে যুক্ত করেছে। সেতুতে চলতে চলতে দুলতে হয়, যা পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।
পলওয়েল পার্ক বাংলাদেশ পুলিশের পরিচালিত এই পার্কে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সুইমিং পুল, বিভিন্ন শিশুতোষ রাইড এবং নাইন ডি মুভি দেখার সুযোগ। এখানে কটেজ সুবিধাও রয়েছে, যেখানে শুয়ে শুয়ে হ্রদের বিশালতা উপভোগ করা যায়। এছাড়াও পার্কে দেশের প্রথম লাভ পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এই লাভ পয়েন্টের পেছনে রয়েছে একটি করুণ ইতিহাস। আমেরিকান প্রবাসী আলাউদ্দিন-লিমা দম্পতি হানিমুনে রাঙ্গামাটিতে এসে হ্রদ ভ্রমণের সময় আকস্মিক ঝড়ে ডুবে যান। ডুবুরি দল দুই দিন খুঁজেও তাদের উদ্ধার করতে পারেনি। তৃতীয় দিন সকালে পলওয়েল পার্কের কাছে তাদের আলিঙ্গনরত অবস্থায় মরদেহ ভেসে ওঠে। এই ভালোবাসার বন্ধন রাঙ্গামাটিবাসীকে আপ্লুত করে, ফলে তাদের স্মরণে লাভ পয়েন্ট স্থাপন করা হয়।
মুগ্ধতার সড়ক (আসাম বন্তি-কাপ্তাই সড়ক) পাহাড়ের বুক চিরে এঁকে বেঁকে চলে গেছে এই সড়ক, যার একপাশে বিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশি এবং অন্যপাশে বিশাল পাহাড়। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি গাড়িতে বসেই পাহাড় ও হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার এক অনন্য সুযোগ প্রদান করে। বিধাতার হাতের সৃষ্টির মতো এ সৌন্দর্যকে স্থানীয়রা “মুগ্ধতার সড়ক” নামে ডাকেন। পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও প্রিয় স্থান এই সড়কটির পাশে বেশ কিছু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, যেখানে রয়েছে রাত্রি যাপনের সব সুবিধা এবং ক্যাম্পফায়ারের সুযোগ। ইচ্ছা করলে তাবুতেও থাকতে পারবেন।
হাউজ বোট গত ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্পে যুক্ত হয়েছে হাউজ বোট। বর্তমানে এখানে ১২টি হাউজ বোট রয়েছে, প্রতিটিতেই থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। হ্রদের বুকে ঘুরে বেড়ানো এই বোটগুলো যেন এক একটি ভাসমান বাড়ি, যেখানে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা মেলে। বিভিন্ন প্যাকেজে এই বোটে কাটানো যায় রাত, যা পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বিলাইছড়ি রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা ইতোমধ্যে ‘ঝরনার উপজেলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য ঝরনা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গাছকাটা ঝরনা, ন কাটা ঝরনা ও ধূপপানি ঝরনা। ভারতের মেঘালয়ের ঝরনাগুলোর সাথে তুলনা করলে, এ ঝরনাগুলো কোনো অংশে কম নয়। ঝরনাগুলোর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সেরা সময় জুন থেকে নভেম্বর। ঝরনাগুলোর কাছে পৌঁছাতে হলে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ও পরিশ্রমী হতে হবে, কারণ ভঙ্গুর পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হয়। প্রথমে মনে হতে পারে যে এই ঝরনায় কখনই পৌঁছাতে পারবেন না, কিন্তু ঝরনার দেখা পেলে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। তখনই মনে হবে আবার আসতে হবে এই ঝরনায়।
সাজেক ভ্যালি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক ভ্যালি, যা মেঘের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। যদিও সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায়, যাতায়াত করতে হয় পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মধ্য দিয়ে। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘ ছোঁয়া যায়, কখনো কখনো মেঘ রুমের ভেতরও প্রবেশ করে। কংলাক পাহাড় থেকে সূর্যোদয় দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
অন্যান্য পর্যটন স্পট রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট, যেমন জীবতলী, নেভীক্যাম্প, প্রশান্তি পার্ক, পড হাউজ। প্রতিটি স্থানেই রয়েছে থাকার ও খাওয়ার সুব্যবস্থা। এছাড়াও জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রিসোর্ট, যেমন মায়াবি দ্বীপ, রাঙ্গাদ্বীপ, বার্গি, রাইন্যাটুগুন, রড়গাঙ্গ, বেরাইন্যা।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে স্থানীয় পর্যটন জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত। জেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশে জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, ‘রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে দেয়া হয়েছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদনে অপেক্ষায় আছে। এটি পাস হলে এই জেলার চেহারা পাল্টে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মেগা প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বসে নেই। পরিষদের আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহণ করছি। মোট কথা কাজ থেমে নেই। আমরা চাই বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের আইডল জেলা হবে রাঙ্গামাটি। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’